ক্যারিয়ার শব্দটি অত্যন্ত আপেক্ষিক, অনুভূতির এবং ভাবাবেগের। ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ/অপছন্দের উপর নির্ভর করে বাস্তবতার নিরিখে বিবতর্নের তাগিদে ক্যারিয়ার ভিত্তিক স্বপ্ন তরুণদের পথ দেখায়। অবশ্য ক্যারিয়ারের ভিত্তি উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রোথিত এবং আজীবনের অকুন্ঠ লক্ষ্য হিসেবে পূরণের জন্য আকাঙ্খা থাকে। সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের জন্য কর্মপ্রচেষ্টার কমতি থাকেনা মানুষের মধ্যে।

আবার অনেকেই রয়েছেন পথচ্যুত হয়ে দিকভ্রান্তের ন্যায় জীবন আস্বাদনে ব্যর্থ হয়ে যাযাবরের ন্যায় জীবনকাল অতিবাহিত করে থাকে এবং তাদেরকে এ সমাজ কখনো মনে রাখে না কিংবা মনে রাখার মতো তেমন অর্থবহ কোন বিশেষ কর্মসাধনে ব্যর্থ হয়। আবার অনেকেই রয়েছেন যাদেরকে পৃথিবী মৃত্যুর পরে তাদের কর্মের জন্য সুমহান কর্মকাণ্ডের জন্য উজ্জ্বল্যভরে স্মরণ করে, অন্যদের জন্য উদাহরণ হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে আসীন থাকে।

মানুষের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে ক্যারিয়ারের বিকল্প নেই পাশাপাশি ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং পরিচয়ের বাহন হিসেবেও ক্যারিয়ারের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের চেষ্টা করে থাকে অনেকেই। ক্যারিয়ারের স্বপ্নকে ঘিরেই মানুষের মধ্যেই ক্যারিয়ার ভিত্তিক চিন্তা চেতনার আবির্ভাব ঘটে থাকে। করোনার মহামারীতে তরুণদের মধ্যে ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা ও দুশ্চিন্তার রেখাপাত ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। কেননা এই দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনে স্বপ্ন পূরণের মহাকালের যাত্রায় স্থবির হয়ে পড়ছে পুরো পৃথিবী, সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে তরুণদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন তরুণদের উৎসাহী, আগ্রহী, জীবনের প্রতি অর্থবহ করে তুলে। কিন্তু করোনার এই দুর্বিপাকে মহাকালের অনিশ্চিত যাত্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে লক্ষ কোটি তরুণের ক্যারিয়ার যাত্রার বিরামহীন পথের অগ্রণী যাত্রা। তবে আমরা আশা করবো, অহর্নিশ কালো মেঘ কেটে পৃথিবীর বুকে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় চাপিয়ে দেওয়ার একটি প্রবণতা দীর্ঘকাল ধরে এখনো বলবৎ রয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের পছন্দকে কিংবা পছন্দ করার মানসিকতাকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করার অপপ্রয়াস দেখা যায়। অর্থাৎ নবম শ্রেণিতে গ্রুপ নির্ধারণের সময় অভিভাবক এবং শিক্ষকের মতামতের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এমন একটি ধারণা পোষণ করা হয় যেখানে দেখা যায় প্রথম ক্যাটাগরির ছাত্রদেরকে বিজ্ঞানে পড়ার জন্য পরিবার এবং শিক্ষকদের পক্ষ থেকে মটিভেশন দেওয়া হয়ে থাকে অর্থাৎ ক্যারিয়ার ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থীদের সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি।

শিক্ষার্থীকে বাস্তবতা নিরিখে পছন্দের গ্রুপ বাছাই করার জন্য উপযুক্ত মটিভেশন ও বোঝানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়ে থাকে, ফলে ভাল-মন্দ, যৌক্তিকতার মিশেলে বিভাগ পছন্দ করার বিষয়টিতে শিক্ষার্থীদের ফ্রন্টলাইনের বাইরে রাখা হয়। পরবর্তীতে ইন্টারমিডিয়েট ভর্তির সময়ও সিজিপিএ দিয়ে কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ রয়েছে সেটি বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয়ে থাকে, অনেক অভিভাবকই বিভাগ নির্ধারণ না করে প্রতিষ্ঠানের চিন্তা করে শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে থাকে। ভবিষ্যৎ লক্ষ্যকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের গ্রুপ নির্ধারণের বিষয়টিও অনেক সময়ই অবান্তর হিসেবে বিবেচিত হয়ে তাকে। যেখানে শিক্ষার্থীর তুলনায় অভিভাবকের ইচ্ছাকে প্রায়োরিটি দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু যেখানে পড়াশোনাটা করবে শিক্ষার্থী সেখানে শিক্ষার্থীর পছন্দকে খাটো করে দেখা হয়, কাজেই সেখানে ক্যারিয়ারের স্বপ্ন সুনির্ধারন করতেও শিক্ষার্থীকে বেগ পেতে হয় এবং পরবর্তীতে স্বপ্ন বাস্তবায়নে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও বিচক্ষণতার অভাব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় দেখা যায় পছন্দের বিভাগে ভর্তি না হতে পারলেও নামকাওয়াস্তে নিয়ম অনুসরণ করেই ভর্তি হয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে থাকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। কেননা এইচ এস সি পরীক্ষায় যত সংখ্যক ছেলেমেয়ে উত্তীর্ণ হয় ঠিক ততসংখ্যক সিট বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই আবার থাকলেও পছন্দের বিভাগে অনেকেই ভর্তি হতে না পেরে হতাশায় থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে থাকে। মনের বিরুদ্ধে প্রকৃতঅর্থে যুদ্ধ করা যায় না তবুও মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শিক্ষাজীবন শেষ করে অনেকেই জীবনের প্রয়োজনে নানা ধরনের চাকুরিতে যোগদান করে থাকে কিন্তু সে চাকুরি তার লক্ষ্যতে ছিল না।

কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই শিক্ষাজীবন শেষ করে থাকে। কাজেই স্বপ্ন এবং গতিপথ এক না হওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থী লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়ে। লক্ষ্যচ্যুত শিক্ষার্থীরা ক্যারিয়ার নিয়ে নিয়মমাফিক স্বপ্ন দেখে না। ক্যারিয়ার প্রকৃতপক্ষে একটি রুটিনমাফিক পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। ধাপে ধাপে ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে সফলতার সিঁড়িকে অর্জনের নিমিত্তে কাজ করার অভিপ্রায় ব্যতীত কেউ ক্যারিয়ারে সফলতা পায় না।

তবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই হোক কিংবা অন্য যে কোন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হোক না কেন একাডেমিক শিক্ষা আর প্রফেশনাল এক্সিলেন্সির সামঞ্জস্যতা তেমন নাই বললেই চলে। আমার মনে হয় এ কারণেই ক্যারিয়ারের স্বপ্ন পূরণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণে ভাটার সঞ্চার হয়। তবে চাকুরির সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে ৪ বছর মেয়াদী অনার্স ডিগ্রী, ১/১.৫ বছর মেয়াদী মাস্টার্স ডিগ্রীর কার্যকারিতা তেমন কাজে আসে না মর্মে প্রতীয়মান হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী অনার্স ভর্তি হওয়ার পর থেকে বিসিএস নামক সোনার হরিণ অর্জনের প্রত্যাশায় কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে একাডেমিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে চাকুরি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় কোন শিক্ষার্থী যদি একাডেমিক পড়াশোনায় আগ্রহী হয়ে উঠে তাহলে তার পক্ষে অনার্স জীবনের প্রথম থেকে চাকুরির জন্য নিজেকে তৈরি করার মানসিকতা বপন করার কথা নয়। একাডেমিক শিক্ষায় উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির জন্য তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞানের বিকাশের জন্য শিক্ষার্থীর মধ্যে যে নেশার মনোজাগতিক প্রবৃদ্ধি একীভূত করার প্রয়োজন রয়েছে সেটি হয়তো শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মনোবাসনায় জাগরুক করতে ব্যর্থ হয় কিংবা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা ওয়াকিবহাল নয়। সার্বিক দিক বিবেচনায় দেখা যায় চাকুরি পাওয়া শিক্ষার্থীদের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞানার্জন করা, জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখায় বিচরণ করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে বাংলাদেশের উন্নতিকল্পে উদ্ভাবনী কাজে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো।

একবার ভেবে দেখবেন চাকুরি পরীক্ষায় প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় অনার্স এবং মাস্টার্স থেকে কোন প্রশ্নই করা হয় না। সঙ্গত কারণেই অধিকাংশ শিক্ষার্থী একাডেমিক পড়াশোনা থেকে নিজেদের ঘুটিয়ে নেয়। কাজেই, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। যেমন বাংলা থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীকে যেন ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা কিংবা ভাষার যথার্থ ব্যবহার, ভাষার বিকাশ ও বিস্তারে কাজ করা যায় এমন সেক্টরে কাজের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ব্যাংকিং, ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং থেকে পাশ করে ছেলেমেয়েদের ব্যাংকিং সেক্টরে কিংবা অর্থনৈতিক সংস্থায় এবং অর্থ সংক্রান্ত পরিচালনায় উক্ত বিভাগের শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব প্রদান করা উচিত। পেশাগত বৈচিত্র্যতা সময়ের আকাঙ্খায় পরিণত হয়েছে, কেননা দেখা যায় এমবিবিএস পাশ করা শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ৪ বছর মেয়াদী অনার্স সহ অন্যান্য ডিগ্রী ও মাস্টার্স ডিগ্রী যেন শিক্ষার্থীরা তাদের পেশাগত জীবনে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায় সে মর্মে আমাদের প্রশাসনিকব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো উচিত। তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে একাডেমিক জ্ঞানকে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবে এবং সেভাবে রেখাপাত করে কর্মপন্থা ঠিক করতে পারবে এবং সেটিই হবে সঠিক কর্মধারা।

Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *