একটি বিল্ডিং শুধু ইট-বালি দিয়েই নির্মাণ করা যায় না, সিমেন্ট, রড, শ্রম, অর্থ ও অন্য অনেক জিনিসের প্রয়োজন হয়। একটি অফিস শুধু ম্যানেজার একাই পরিচালনা করতে পারেন না, অন্যান্য সহকর্মীরও দরকার হয়। ছোট একটি বাসেও যেমন ড্রাইভারের পাশাপাশি হেলপার ও কন্ডাক্টরের প্রয়োজন হয়। ঠিক তেমনি একটি দেশ পরিপূর্ণ হতে হাজারো পেশার মানুষের প্রয়োজন হয়। দেশ যেন একটি ফুলের বাগান, বিভিন্ন পেশার মানুষ যেন এক একটি ফুল এবং একেক ফুলের একেক রকম ঘ্রাণ।

ইরানি সাহিত্যিক ও দার্শনিক, শেখ সাদী এক রাজার আমন্ত্রণে খুবই সাধারণ পোশাকে রাজদরবারে যাওয়ার পথে, রাত হয়ে গেলে, এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। তার পোশাক দেখে তারা তাকে সাধারণ পেশার মানুষ মনে করে, সাধারণ খাবার ও সাধারণভাবে থাকার ব্যবস্থা করল অর্থাৎ খুব বেশি সমাদর করল না। পরের দিন রাজার কাছ থেকে বিভিন্ন উপঢৌকন ও দামি পোশাক পরিচ্ছদ উপহার পেয়ে, রাজকীয় হালে ফেরার পথে আবারও সেই বাড়িতে আশ্রয় নিলে, তারা তাকে উচ্চ মর্যাদার পেশাজীবী মনে করে ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেছিল। এভাবে আমাদের সমাজেও অনেকে আছি যারা মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ ও পেশাকে মাপকাঠি হিসেবে ধরে ব্যক্তির মূল্যায়ন করে থাকি।

আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের নাম অনেকেই শুনেছেন হয়তো। তিনি নয় বছর বয়সে তার মাকে হারান। খুব অল্প বয়সেই দরিদ্র পরিবারের হাল ধরেন। কখনো নৌকা চালিয়ে, আবার কখনো কাঠ কেটেও সংসার চালিয়েছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তিনি কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।  আজও তিনি পৃথিবীর মানুষের কাছে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে অমর হয়ে আছেন।

পূর্ব জীবনে মুসলিম বিশ্বের জনপ্রিয় নেতা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের শরবত বিক্রি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চা বিক্রি, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর ফার্নিচারের দোকানি থাকা, ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বাস চালানো, বৃটেনের নির্বাচিত তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ম্যাক ডোনাল্ড এর ক্ষেতমজুরের কাজ ও ইতালির প্রেসিডেন্ট মুসোলিনির দোকানের কাজের কথা সকলেরই জানা।

তাছাড়াও বিশ্বের অধিকাংশ বড় বড় মনীষীরাও ছিল সাধারণ পেশাজীবী পরিবারের সন্তান। এমনকি কৃষক, মুচি, ঝাড়ুদার ও বর্তমান সমাজে কথিত নিম্নমানের পেশা থেকে, প্রেসিডেন্ট, বিশ্ববিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। যাদেরকে আমরা সর্বদা সম্মান করি, কখনোই অসম্মান করি না। আমরা যদি কোনো পেশাকে ছোট করে দেখি, তাহলে আমার মতে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কিন্তু তাদেরই অর্থাৎ পৃথিবীর এই সূর্যসন্তানদেরই ছোট করা হয়।

মানুষের বেঁচে থাকতে হলে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আর জীবিকার জন্য পরিবেশ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করতে হয়। এ পেশার জন্য অনেককে কেউ কেউ মানুষই মনে করে না। আমরা যারা নিজেদেরকে উচ্চশ্রেণির মানুষ হিসেবে দাবি করি এবং সুউচ্চ অট্টালিকার স্বর্ণখচিত জানালা দিয়ে নিম্নশ্রেণিদের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাই, তারা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি যে, আমাদের টাকা আর সম্পদই আমাদের উচ্চশ্রেণিতে সমাসীন রাখতে পারে না?  বরং, আমাদের ব্যবহার্য প্রতিটা জিনিসের পেছনেই কথিত নিম্নশ্রেণির পেশাজীবিদেরই ঘামের ছোঁয়া রয়েছে? হ্যাঁ, আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আমাদের পরিহিত কাপড়-চোপড়, বসবাসের ঘর, উঁচু দালান, ফার্নিচার, প্রতি লোকমা খাবার, যানবাহন, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য অন্যান্য প্রতিটি জিনিসের সাথে ভিন্ন ভিন্ন পেশাজীবিদের শ্রমের সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ সামাজিক জীব। একে অপরকে ছাড়া কখনোই কেউ পরিপূর্ণ হতে পারে না। সবাই সবার ওপর নির্ভরশীল। ভিন্ন ভিন্ন পেশার জন্যই আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন সব চাহিদা মেটাতে সক্ষম হই।

ধরুন, আজকে পৃথিবীর সব নাপিত একযোগে তাদের পেশা বাদ দিয়ে দিলো। এখন একটু চিন্তা করে দেখুন তো, এমন হলে এক মাস বা দুই মাস পর কী অবস্থা হতে পারে? নিঃসন্দেহে পুরো পৃথিবীতে সাধারণ নিয়ম ব্যাহত হবে। কারণ, প্রায় প্রতিটি মানুষ এই পেশার ওপর নির্ভরশীল। কথিত নিম্নমানের অন্যান্য সব পেশাজীবিদেরও এমন অনুপস্থিতি পৃথিবীর সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাবে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।

একদিন আমি আমার কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে, এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমার একটি জুতা ছিড়ে গিয়েছিল। দুর্গম এলাকা হওয়াতে আশেপাশে কোনো দোকানপাট বা বাজারই পাওয়া যাচ্ছিল না, আবার মুচি তো দূরের কথা। যারা এমন বিপদে পড়েছেন তাদের বোঝার কথা। সেদিন আমি জুতা হাতে করে, প্রায় তিন কিলোমিটার কর্দমাক্ত রাস্তা খালি পায়ে হেঁটে, এক বাজারে গিয়ে মুচি পেয়েছিলাম এবং তারপর জুতা সেলাই করিয়ে বাড়িতে ফিরেছিলাম। মুচির গুরুত্ব আমি সেদিন খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলাম। আবার ২০১৮ সালে, ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে থাকাকালে, বাসার বাথরুম ব্লকড হওয়ার পর বুঝেছিলাম মেথরের কত প্রয়োজনীয়তা।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও কালের প্রয়োজনে সব জাতীয় স্বার্থে, আমাদের দেশের সব পেশাজীবী মানুষেরই কিন্তু স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। সব পেশার মানুষের চাহিদা, চাওয়া ও পাওয়াই ছিল প্যারালাল। এদিক বিবেচনায়ও কোনো পেশাকে ও মানুষকে অন্য চোখে দেখার সুযোগ নেই।

সাশা ওবামা হলেন, এক সময়ের দাপুটে বিশ্বনেতা ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ছোট মেয়ে। হোয়াইট হাউজের আরাম-আয়েশ ছেড়ে, কোনো অভাব না থাকা সত্ত্বেও, তাকে কিছুদিন একটি সী-ফুড রেস্টুরেন্টের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল। তার পরিবারের কথা হলো, তাদের সন্তান যেন আরাম-আয়েশে থেকে কোনো কাজে ও কর্মজীবী মানুষের প্রতি ঘৃণা ও অবহেলা নিয়ে বড় না হয়।

ইতিহাস সাক্ষী, আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সব শ্রেণির মানুষের সাথে মিশে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকেও সাধারণ শ্রমিকদের সাথে মাটির ঝুড়ি বহন করে খাল খননে অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল। এই ঘটনাগুলো সব পেশা ও মানুষকে সম্মান করতে শেখায়।

একটা দেশে খনিজ সম্পদ, প্রাণীজ সম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও কৃষিজ সম্পদসহ সব সম্পদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো মানবসম্পদ। মানবসম্পদের স্বার্থেই অন্য সব সম্পদের সৃষ্টি। সব সম্পদ এই মানব সম্পদের দ্বারাই পরিচালিত হয় এবং তা ব্যবহার উপযোগী হয়। আর এজন্যই মানুষকে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকতে হয়। আমাদের সমাজে সাধারণত কোনো কোনো পেশাকে উচ্চশ্রেণির আবার কোনোটা নিম্নশ্রেণির বলে সম্বোধন করতে দেখা যায়।

শুরুতেই বলেছি সব পেশার মানুষই দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করে থাকে। আমার প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন পেশার জন্য মানুষ ছোট হবে? কোনো রকম বৈষম্য, অভাব, ভয়-ভীতি ও প্রতিবন্ধকতা ব্যতীত এবং মৌলিক অধিকারসহ সব ধরনের স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার সবারই আছে। কেউই কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার বিন্দুমাত্র অধিকার রাখে না।

এজন্য আমাদের স্থির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন করে অর্থাৎ ‘পেশার জন্য মানুষ ছোট হতে পারে না’ এমন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে সমতার পৃথিবী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, সবাইকে একযোগে এগিয়ে চলার প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে।

লেখক:মোঃ জাফর আলী, শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *